ষড়ঋতুর দেশ বাংলাদেশ। দুই মাস পর পরই আমাদের দেশে ঋতুর পরিবর্তন হয়। এই ঋতু পরিবর্তনে এখন বইছে শরৎকাল। আর প্রকৃতিতে যখন শরৎকাল আসে তখন কাশফুলই জানিয়ে দেয় শরতের আগমনী বার্তা। শরতের বিকালে নীল আকাশের নিচে দোলা খায় শুভ্র কাশফুল। হাওর ও নদী রেষ্টিত নবীনগর উপজেলার বিভিন্ন খাল বিলের পাড় সাদা হয়ে আছে কাশফুলে। নাগরিক কোলাহল আর যাপিত জীবনের নানা ব্যস্ততার মাঝে চুপিচুপি আসে শরৎ। মাতোয়ারা করে নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলায়, কাশফুলের শুভ্রতায় কিংবা শিউলির ঘ্রাণে। তারপর, হারিয়ে যায় দ্রুতই। শরৎ আসলে এমনই, স্নিগ্ধতার আবেশ ছড়িয়ে স্মৃতিতে দোলা দেয় সব ঋতুতে। তবে কিছু কিছু কাশফুল রাজধানীর উত্তরার দিয়াবাড়ী, কেরানীগঞ্জে, কাচপুর ব্রীজের পাশে দেখা যায়।
গ্রামীণ জনপদ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী কাশবন। ঋতু অনুসারে ভাদ্র-অশ্বিনজুড়ে শরৎকালের রাজত্ব। নিকট অতীতেও দেখা গেছে শরৎকাল এলেই গ্রামবাংলার ঝোপ-ঝাড়, রাস্তা-ঘাট ও নদীর দুই ধারসহ আনাচে-কানাচে কাশফুলের মন মাতানো নাচানাচি। সেগুলো আর চোখে পড়ছে না। কাশবনের ফুলগুলো দোল খেতো একটার সঙ্গে আরেকটা। এ সময় অজান্তেই মানুষের মনে ভিন্ন রকম আনন্দের ঝিলিক বয়ে যেতো। কবি জীবনন্দ দাশ শরৎকে দেখেছেন, বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই পৃথিবীর রুপ খুঁজিতে যাই না আর। শরতের এই অপরূপ রুপ দেখে মুগ্ধ কবি অবলীলায় পৃথিবীকে আর দেখার প্রয়োজন নেই সিদ্ধান্ত নেন। শরৎ শুভ্রতার ঋতু। শরৎ মানেই প্রকৃতি শরৎ মানেই নদীর তীরে তীরে কাশফুলের সাদা হাসি। তবে এবার একটু দেরিতেই কাশফুল ফুটতে দেখা যায়। বাংলার প্রকৃতিতে শরতের এই দৃশ্য দেখলে যে কেউই মুগ্ধ হয়ে যায়। জানা যায়, প্রাচীনকাল থেকেই এ দেশের মাঠে-ঘাটে কাশফুল ফুটতে দেখা যায়। এমনকি প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে এদেশে কাশফুল ছিল।
বাংলাদেশের সব অঞ্চলেই নদীর ধার, জলাভূমি, চরাঞ্চল, শুকনো এলাকা, পাহাড় কিংবা গ্রামের কোনো উঁচু জায়গায় কাশের ঝাড় বেরে ওঠে।এরা ঘাসজাতীয় জলজ উদ্ভিদ। চিরল পাতার দুই ধারে খুবই ধার। পালকের মতো নরম এর সাদা ফুল। কাশফুলের অন্য একটি প্রজাতির নাম কুশ। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পবিত্র ধর্ম গ্রন্থ ‘পুরাণ’-এ কুশের স্থান খুব উঁচুতে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রাচীন গ্রন্থ ‘কুশজাতক’ কাহিনী অবলম্বন করে ‘শাপমোচন’ নৃত্যনাট্য রচনা করেছেন। কাশফুল মনের কালিমা দূর করে। শুভ্রতা অর্থে ভয় দূর করে শান্তির বারতা বয়ে আনে। শুভ কাজে ব্যবহার করা হয় কাশফুলের পাতা বা ফুল।
নদীর দু’ধারে, আইলে শরৎকালের সেই চিরচেনা দৃশ্য আর দেখা যায় না। কালের আবর্তে হারিয়ে যাচ্ছে কাশবন। এখন গ্রামবাংলায় বিচ্ছিন্নভাবে থাকা যে কয়টি কাশফুল চোখে পড়ে সেগুলোও হারিয়ে যাচ্ছে। সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে সেখানে এখন তৈরি হয়েছে মৌসুমী ফসলের ক্ষেত। কাশফুল ছিঁড়ছে একটি শিশু। নদীর পাড়ে গড়ে ওঠা শহরগুলো এভাবেই শরতের সৌন্দর্যকে শুইয়ে দিচ্ছে সাদা কাফনের ভেতরে। সাধারণ মানুষের বিনোদন-প্রকৃতিতে দেখার শখ-আহ্লাদ যেন হারিয়ে যেতে বসেছে। এ কাশবন চাষে বাড়তি পরিচর্যা ও সার প্রয়োগের প্রয়োজনও নেই। আপনা থেকে অথবা বীজ ছিটিয়ে দিলেই কাশবনের সৃষ্টি হয়ে থাকে।
কাশবনের ব্যবহার বহুবিধ। চারাগাছ একটু বড় হলেই এর কিছু অংশ কেটে গরু-মহিষের খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা যায়। কাশ দিয়ে গ্রামের বধূরা ঝাটা, ডালি, দোন তৈরি করে আর কৃষকরা ঘরের ছাউনি হিসেবেও ব্যবহার করে থাকেন। তিতাস নদী তীরে কাশবন দেখা মিলে। তখন মানুষ নিজের অজান্তে হারিয়ে যায়। অতীত হাতড়ে থাকে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মেঘের সাথে সূর্যের লুকোচুরিতে শরতের মায়াময় প্রকৃতি সাজে ভিন্ন ভিন্ন রুপে। মেঘের ঋতু শরৎ শুভ্রতা, স্বচ্ছতার প্রতীক। আর এই শুভ্রতা মানুষের মনকে করে পবিত্র, প্রশান্ত। তাইতো ঋতু বা প্রকৃতির কাছে শুধু চাইলেই হবে না, নগরায়নের প্রভাব থেকে একে রক্ষায় দায়িত্ব নিতে হবে সবাইকে, সমানভাবে।