কয়েক দিন আগে কেনাকাটা করতে গিয়েছিলেন মিরপুরের বাসিন্দা ফারজানা খালিদ। তিনি বলেন, সেখানে কয়েকটি দোকানে কেনাকাটার পর ফোন নম্বর একটি বইয়ে লিখে দিতে বলা হয় তাকে। যা তাকে কিছুটা অবাক করলেও সেটিকে পাত্তা না দিয়ে নম্বর লিখে দিয়েছেন তিনি। তবে তিনি অবাক হতে শুরু করেন যখন কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করে তার নম্বরে বিভিন্ন সুযোগ এবং অফারের ক্ষুদে বার্তা আসতে থাকে। মিসেস খালিদ বলেন, সে সব জায়গা বা প্রতিষ্ঠান থেকে কখনো কোনো ধরনের কেনাকাটা বা সেবা নেননি তিনি।
‘কয়েক দিন আগে চালডাল ডটকম থেকে আমার কাছে একটি মেসেজ আসে। কিন্তু সেখান থেকে কখনো কিছু কেনাকাটা করি নাই। আবার মোহাম্মদপুরের লিংজার্ড নামে একটা পার্লার থেকে একটা প্যাকেজ অফারের মেসেজ আসে। ঐখানে তো আমি কখন যাই-ই নাই’ বলেন মিসেস খালিদ। এ ধরনের অভিজ্ঞতা হয়তো অনেকেরই আছে। অর্থাত্ ফোন নম্বর ব্যক্তিগত তথ্য হওয়া সত্ত্বেও তা আর গোপন রাখা যাচ্ছে না। আবার নতুন কোনো ধরনের অ্যাপ ব্যবহার শুরুর সময় যে চুক্তিপত্র দেওয়া হয়ে থাকে, সেগুলো ভালোভাবে না পড়েই সব কিছুতে অনুমোদন দিয়ে দেওয়া হয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। প্রশ্ন দেখা দিয়েছে যে, গোপনীয়তা সম্পর্কে আসলে মানুষের মধ্যে কতটা সচেতনতা রয়েছে?
সচেতনতা কতটুকু রয়েছে?
মিসেস খালিদ জানান, এর আগে নাম, পরিচয় বা ঠিকানা, ফোন নম্বর এসব বিষয় গোপন রাখার বিষয়ে তেমন সতর্ক ছিলেন না তিনি। ‘এগুলো গোপন রাখার মতো কিনা তা আমার মাথায় কখনো আসে নাই’ তিনি বলেন।
গোপনীয়তার বিষয়ে প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ এবং ইউল্যাব ইউনিভার্সিটির শিক্ষক ড. সুমন রহমান বলেন, অনেক ওয়েবসাইট এবং অ্যাপ ব্যক্তিগত তথ্য তৃতীয় পক্ষের কাছে বিক্রি করে দেয়। যার কারণে তৃতীয় পক্ষে এসব তথ্য নিয়ে ই-মেইল অ্যাড্রেস এবং ফোন নম্বরে পুশ করতে থাকে।
তিনি বলেন, ‘এই পক্ষগুলো যে আপনার ব্যক্তিগত তথ্যগুলো সংরক্ষণ করছে না তার কোনো প্রমাণ নেই। কারণ এগুলো যে পর্যায়ে ঘটে সেখানে ইউজার বা ব্যবহারকারীরা পৌঁছাতে পারে না।’ এ বিষয়গুলো নিয়ে সচেতনতা একটি শ্রেণির মধ্যে তৈরি হওয়া শুরু হলেও বেশিরভাগ মানুষ এ বিষয়ে সচেতন নয় বলে জানান মিস্টার রহমান। ‘বিরাট জনগোষ্ঠী প্রাইভেসি নিয়ে মাথা ঘামায় না। তাদের তথ্য যে সংবেদনশীল হতে পারে এ বিষয়টি তাদের মাথায় খুব ধীরে ধীরে আসছে’ বলেন তিনি।
গোপনীয়তার অধিকার সম্পর্কে আইন কী বলে?
বাংলাদেশের সংবিধানের ৪৩ নম্বর ধারা অনুযায়ী ব্যক্তির গোপনীয়তার অধিকার মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে বিবেচিত। অর্থাত্ নাগরিক হিসেবে ব্যক্তিগত তথ্য গোপন করার পূর্ণ অধিকার রয়েছে মানুষের। এছাড়া তথ্য অধিকার আইনের ৭ এর (জ) ও (ঝ) নম্বর ধারা অনুযায়ী কারো ব্যক্তিগত তথ্য দেওয়া বাধ্যতামূলক নয়। এসব ধারায় বলা হয়েছে যে, কোন ব্যক্তির তথ্য প্রকাশের ফলে তার ব্যক্তিগত জীবনের গোপনীয়তা ক্ষুণ্ন হতে পারে এমন তথ্য প্রকাশ বাধ্যতামূলক নয়।
আরেকটি ধারায় বলা হয়েছে যে, কোনো তথ্য প্রকাশের ফলে কোনো ব্যক্তির জীবন বা শারীরিক নিরাপত্তা বিপদাপন্ন হতে পারে এমন কোনো তথ্য চাওয়া যাবে না। এসব তথ্যের মধ্যে রয়েছে ব্যক্তির নাম, ঠিকানা, রোগীর ব্যক্তিগত তথ্য ইত্যাদি। এসব তথ্য কারো অনুমতি ছাড়া দেওয়া যাবে না।
এ বিষয়ে আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, ব্যক্তিগত গোপনীয়তা বলতে যা বোঝায় সেটি হলো কোনো ব্যক্তি তার ব্যক্তিগত তথ্য সংরক্ষণ করে রাখতে পারবে, সেখানে কেউ হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। এটি আইন দিয়ে নিশ্চিত করা আছে। ‘তবে যদি তার বিরুদ্ধে কোনো অপরাধ করার অভিযোগ ওঠে এবং তদন্তের দরকার হয় তখন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তা খতিয়ে দেখতে ব্যক্তিগত তথ্য জানতে চাইতে পারবে’ তিনি বলেন।
কী কী তথ্য গোপন রাখার অধিকার রয়েছে?
বাংলাদেশে ২০০৬ সালের যে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন রয়েছে সেটি অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তির অনুমতি ছাড়া ইলেকট্রনিক রেকর্ড, যোগাযোগ সম্পর্কিত তথ্য ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় তথ্য প্রকাশ করলে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। অর্থাত্ এসব তথ্য গোপন রাখার অধিকার ব্যক্তির রয়েছে। এছাড়া তথ্য অধিকার আইনে ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা বিষয়ে কয়েকটি অনুচ্ছেদ রয়েছে। ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তার অধিকারের মধ্যে রয়েছে আয়-ব্যয় সংক্রান্ত তথ্য, অসুস্থতাজনিত তথ্য, যোগাযোগ সম্পর্কিত তথ্য যেমন ফোন বা মোবাইল নম্বর, পাসপোর্টের তথ্য ও নম্বর, অন্যান্য পরিচয়পত্রের তথ্য ও নম্বর ইত্যাদি। এছাড়া ই-মেইল, চিঠির ঠিকানাও যোগাযোগের গোপনীয়তার মধ্যে পড়ে।
ব্যক্তির গোপনীয়তার ক্ষেত্রে বাসস্থান, কর্মক্ষেত্র বা জনসমাগম স্থান প্রভৃতি জায়গায় অন্যের অবৈধ অনুপ্রবেশকে সীমাবদ্ধ করাও ব্যক্তির গোপনীয়তার অন্তর্ভুক্ত। যেমন তল্লাশি, ভিডিও নজরদারি, পরিচয়পত্র যাচাই ইত্যাদি।
মিস্টার মোর্শেদ বলেন, ‘আইনগত বিধি-নিষেধ সাপেক্ষে যে কেউ তার ব্যক্তিগত তথ্য সংরক্ষণ করতে পারবেন। কেউ যদি ফোনে কথা বলে তাহলে সেটি তার গোপনীয় বিষয়, সেখানে কেউ রেকর্ড করতে পারবে না।’ কিন্তু রাষ্ট্রের প্রয়োজনে ও স্বার্থে সেটি রেকর্ড করার কথাও আইনে আছে বলে জানান আইনজীবী মনজিল মোরসেদ।
তথ্য অধিকারের সাথে প্রাইভেসি বা গোপনীয়তার অধিকারের বিরোধ আছে কি?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন তথ্য অধিকারের সাথে ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকারের সংঘাত তৈরি হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, তথ্য অধিকার হচ্ছে যে সব তথ্য রাষ্ট্র, জনগণ ও মানুষের স্বার্থে সবাইকে জানান দরকার। ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকার সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘এক্ষেত্রে জানিয়ে দিয়ে ঐ ব্যক্তির অধিকার ক্ষুণ্ন করা হচ্ছে। এটা ক্ষুণ্নের জায়গা না।’
‘গণতন্ত্র যেমন সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন কিন্তু সংখ্যালঘুর অধিকার ক্ষুণ্ন করে নয়, তেমনি তথ্য আমরা জানতে চাই কিন্তু ব্যক্তির গোপনীয় তাকে ক্ষুণ্ন করে নয়, ’তিনি বলেন। তার মতে ব্যক্তির গোপনীয়তার অধিকার নষ্ট না করেই তথ্য অধিকার বাস্তবায়ন করতে হবে।