ডেঙ্গু জ্বর একটি মশাজনিত বেদনাদায়ক রোগ। ডেঙ্গু জ্বর মশা দ্বারা ছড়িয়ে থাকা চার ধরণের ডেঙ্গু ভাইরাসের যে কোনও একটির কারণে হয়ে থাকে। এই ভাইরাসগুলি সেই ভাইরাসের সাথে সম্পর্কিত যা ওয়েস্ট নিলে সংক্রমণ (West Nile infection) এবং ইয়েলো ফিবার (yellow fever) রোগেরও সৃষ্টি করে। ডেঙ্গু জ্বর ব্রেকবোন জ্বর নামেও পরিচিত। একটি মশা যখন ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিকে কামড় দেয় তখন ভাইরাসটি মশার মধ্যে প্রবেশ করে। সংক্রামিত মশা যখন অন্য ব্যক্তিকে কামড় দেয় তখন ভাইরাসটি সেই ব্যক্তির রক্ত প্রবাহে প্রবেশ করে।
প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী ৪০০ মিলিয়ন ডেঙ্গু সংক্রমণ ঘটে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিশ্বের গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলে এই সংক্রমণ দেখা যায়, যার মধ্যে সবচেয়ে বড় ঝুঁকিপূর্ণ দেশ: ভারতীয় উপমহাদেশ, দক্ষিণ – পূর্ব এশিয়া, দক্ষিণ চীন, তাইওয়ান, প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জ, ক্যারিবিয়ান (কিউবা এবং কেম্যান দ্বীপপুঞ্জ ব্যতীত), মক্সিকো, আফ্রিকা, মধ্য এবং দক্ষিণ আমেরিকা (চিলি, প্যারাগুয়ে এবং আর্জেন্টিনা বাদে)।
ডেঙ্গু জ্বর এডিস মশার কামড় দ্বারা সংক্রমণ হয়। এটি সরাসরি একজন ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তিতে ছড়িয়ে যায় না।
ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ
ডেঙ্গু জ্বর সংক্রমণের দুই থেকে চার দিন পর, এর লক্ষনগুলো শুরু হয় এবং ১০ দিন অবধি থাকে।
১। হঠাৎ, উচ্চ জ্বর
২। মারাত্মক মাথাব্যথা
৩। চোখের পিছনে ব্যথা
৪। গুরুতর জয়েন্ট এবং পেশী ব্যথা
৫। অবসাদ
৬। বমি বমি ভাব
৭। বমি
৮। ত্বকের ফুসকুড়ি, এটি জ্বরের শুরু হওয়ার দুই থেকে পাঁচ দিন পরে উপস্থিত হয়
৯। হালকা রক্তপাত (নাক থেকে রক্ত ঝরা, মাড়ির রক্তপাত, বা সহজ ক্ষত)
ডেঙ্গু জ্বর নির্ণয়
শুধু মাত্র রক্ত পরীক্ষা করে ডেঙ্গু সংক্রমণ শনাক্ত করা সম্ভব। স্বাস্থ্যসেবা পেশাদাররা ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত ব্যক্তিকে সনাক্ত করতে DENV সনাক্তকরণ আইজিএম ক্যাপচার এলিসা নামে একটি রক্ত পরীক্ষা করেন।
ডেঙ্গু জ্বরের চিকিৎসা
ডেঙ্গু সংক্রমণ চিকিৎসার জন্য নির্দিষ্ট কোনও ওষুধ নেই। তবে ২০১৬ সালের এপ্রিলে ডাব্লুএইচও ডেঙ্গু জ্বরের জন্য Sanofi Pasteur’s Dengvaxia (CYD-TDV) ভ্যাকসিনকে অনুমোদন দিয়েছে। এই ভ্যাকসিন ৯-৪৫ বছর বয়সের লোকেরা তিনটি ডোজ নিতে পারবে।
ডেঙ্গু জ্বরের জন্য দেহে ব্যথা হতে পারে, তাই এসিটামিনোফেনের গ্রুপের ওষুধ খাওয়া যেতে পারে এবং এসপিরিনযুক্ত ওষুধগুলি না খাওয়া উচিত। এসপিরিনযুক্ত ওষুধগুলি রক্তক্ষরণের কারন বা রক্তক্ষরণকে আরও বাড়িয়ে দিতে পারে। এসময় বিশ্রাম নেওয়া উচিত, প্রচুর পরিমাণে তরল পান করা এবং আপনার ডাক্তারের সাথে পরামশ করা উচিত। জ্বর কমে যাওয়ার প্রথম ২৪ ঘন্টার মধ্যে যদি খুব বেশি খারাপ লাগতে শুরু করে, তবে জটিলতা পরীক্ষার জন্য তাত্ক্ষণিকভাবে হাসপাতালে যেতে হবে। তীব্র জ্বর এবং পেশী ব্যথা (মায়ালজিয়া) সহ ডেঙ্গু প্রায় এক থেকে দুই সপ্তাহ স্থায়ী হয়। দুর্বলতা (অ্যাসথেনিয়া) এবং ক্লান্তি অনুভূতি দূর করে সম্পূর্ণ সুস্থ হতে প্রায় কয়েক সপ্তাহ সময় নেয়।
ডেঙ্গু জ্বর প্রতিরোধ
ডেঙ্গু জ্বর প্রতিরোধের সর্বোত্তম উপায় হ’ল সংক্রামিত মশার দ্বারা কামড় প্রতিরোধ করা। এডিস মশা পরিষ্কার পানিতে ডিম দেয় তাই কোথাও পানি জমতে না দিয়ে মশার সংখ্যা কমিয়ে আনার প্রচেষ্টা করা।
- ঘরেও মশার রেপেলেন্ট ব্যবহার করুন।
- বাইরে গেলে লম্বা হাতা শার্ট, মোজা এবং দীর্ঘ প্যান্ট ব্যবহার করুন।
- বাড়ির অভ্যন্তরে সম্ভব হলে দরজা ও জানালা বন্ধ করে এয়ার কন্ডিশন ব্যবহার করুন।
- এয়ার কন্ডিশন না থাকলে মশারি ব্যবহার করুন।
- পেঁপে পাতার নির্যাস ডেঙ্গু জ্বরের সময় খাওনো যেতে পারে।
- যদি ডেঙ্গুর লক্ষণ দেখা দেয় তবে আপনার ডাক্তারের সাথে কথা বলুন।
- মশার সংখ্যা কমাতে, মশার বংশবৃদ্ধি করতে পারে এমন জায়গা যেমন পুরানো টায়ার, ক্যান বা ফুলের পাত্র যাতে বৃষ্টির পানি জমতে পারে তা নষ্ট করে ফেলুন। খোলা জায়গায় দীর্ঘ সময় পানি জমিয়ে রাখবেন না।
- বাড়ির কেউ যদি ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয় তবে নিজেকে এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের যেন মশা কামড় না দেয় সেদিকে সচেতন থাকুন। সংক্রামিত সদস্যকে কামড়ানো মশা আপনার বাড়ির অন্যদের মধ্যে সংক্রমণ ছড়িয়ে দিতে পারে। এজন্য সংক্রামিত সদস্যকে সবসময় মশারির মধ্যে রাখুন।
ডেঙ্গু জ্বর প্রতিরোধের জন্য সবকিছুর উপরে ব্যাক্তি সচেতনতা সবচেয়ে বড় ভুমিকা পালন করে। কারন এডিস মশা বংশ বিস্তারের জন্য অনুকূল পরিবেশ আমাদের দ্বারাই সৃষ্ট হয়। আমার যদি একটু সচেতন হয়ে আমাদের বাড়ির চারিপাশ পরিষ্কার রাখি তাহলে এডিস মশা সহজে বংশ বিস্তার করতে পারবে না। আর এডিস মশা সহজে বংশ বিস্তার করতে না পারলে ডেঙ্গু জ্বর অনেক অংশে কমে যাবে।