সুস্থ, সুন্দর দাঁতের রক্ষণাবেক্ষণ অনেক জরুরি। সুন্দর হাসি, পুষ্টিকর খাদ্য, হজমের জন্য সঠিক ভাবে চিবিয়ে খাওয়া এমনকি অন্যান্য রোগ যেমন—হৃদেরাগ, ডায়াবেটিস ইত্যাদি থেকে নিজেকে রক্ষা করা। তা ছাড়া দাঁতের ব্যথা, যন্ত্রণা ও অস্বস্তিকর অবস্থা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখা সুস্থ, সুন্দর দাঁত দীর্ঘদিন অখুন্ন রাখার জন্য বিশেষ কয়েকটি পরামর্শ মেনে চলা প্রয়োজন। যেমন—
১. শিশুর দাঁতের যত্ন : গবেষণায় দেখা যায় প্রতি চার জন শিশুর এক জনের দাঁতের ক্ষয় শুরু হয় শিশু বয়সে এবং ১২ থেকে ১৫ বছরের প্রায় ৫০ শতাংশ ছেলেমেয়েদের দাঁতের ক্যারিজ থাকে। শিশুর দাঁতের যত্ন শুরু করতে হবে যখন থেকে তাদের দাঁত ওঠা শুরু হয়, সাধারণত ছয় মাস বয়স থেকে। বিজ্ঞানরা বলেছেন, এই সময় শিশুর দুধ দাঁত একটি পরিষ্কার ফ্লানেমের কাপড় বা নরম টুথব্রাশ দিয়ে পরিষ্কার করে দিতে হবে। দুই বছর বয়স থেকে শিশুকে নিজ হাতে দাঁত ব্রাশ করার জন্য উত্সাহিত করতে হবে, তবে সেই সাথে নজরদারিও রাখতে হবে।
২. ফিসার সিলেন্ট : মলারের স্থায়ী দাঁত চলে আসে সাধারণত ছয় বছর বয়সে। এ বয়সে ফিসার সিলেন্ট ফিলিং দিয়ে ঐ মলার স্থায়ী দাঁত ভরে দিতে হবে। যাতে করে দন্তক্ষয় না হতে পারে। গবেষণায় দেখা যায় এ ফিলিং দাঁতের ক্ষয় অনেকাংশই প্রতিরোধ করে।
৩. ফ্লুরাইড ব্যবহার : মুখের স্বাস্থ্য রক্ষায় সবচেয়ে বড় যে আবিষ্কার তা হলো ফ্লুরাইড। এই ফ্লুরাইড ব্যবহারে দাঁতের এনামেল মজবুত হয় এবং ডেন্টাল ক্যারিজ থেকে রক্ষা করে। যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে এখন বেশির ভাগ মানুষ ফ্লুরাইড যুক্ত খাবার পানি গ্রহণ করে। তাছাড়া ফ্লুরাইড টুথপেস্ট ব্যবহারে দাঁতের ক্ষয় রোগ কমাতে বিশেষ ভূমিকা রেখে চলছে। অতএব ফ্লুরাইড টুথপেস্ট ব্যবহার করুন।
৪. প্রতিদিন দাঁত ব্রাশ, ডেন্টাল ফ্লস ব্যবহার : মানবজীবনে দাঁতের ক্ষয় ও মাড়ির রোগ দুটি প্রধান সমস্যা। এই সমস্যা শুধু বয়স্কদের নয়, তরুণদের মধ্যে তিন চতুর্থাংশই মাড়ির রোগে ভোগে এবং মাড়ি থেকে রক্ত পড়ে। আমেরিকান ডেন্টাল অ্যাসোসিয়েশনের পরামর্শ অনুযায়ী।
lপ্রতি বছর অতন্ত তিন-চারবার টুথব্রাশ পরিবর্তন করা প্রয়োজন, বিশেষত টুথব্রাশ ফাইবারগুলো যখন বাঁকা হয়ে যায়
lযেসব মানুষ আঁকাবাঁকা দাঁতের জন্য ব্রেসেসস ব্যবহার করেন বা যাদের নকল দাঁত বা ইমপ্ল্যান্ট আছে তারা বিশেষভাবে তৈরি টুথব্রাশ ব্যবহার করবেন।
lবৃদ্ধ মানুষ যাদের আথ্রাইটিজ আছে বা শারীরিকভাবে অসুস্থ তাদের জন্য ইলেকট্রনিক টুথব্রাশ ব্যবহার করা প্রয়োজন।
৫. মুখ কুলকুচি করা : দাঁত ব্রাশ এবং ফ্লাশিং ছাড়াও আরো একটি বিশেষ করণীয় হচ্ছে জীবাণুনাশক মাউথ ওয়াশ দিয়ে মুখ কুলকুচি করা তাতে দাঁতের ক্ষয় রোগ ও মাড়ির রোগ বেশির ভাগই প্রতিরোধ করা যায়। খাবার পর সুগার ফ্রি চুইংগাম ব্যবহারেও অনেক ক্ষেত্রে মুখের লালা প্রবাহ বড়িয়ে এনামেলকে ক্ষয় থেকে প্রতিরোধ করে এবং ব্যাকটেরিয়া মুক্ত করে এবং অ্যাসিডিটির মাত্রাকে সমতায় নিয়ে আসে।
৬. মুখের ওপর যে কোনো আঘাত থেকে রক্ষা করা : বিভিন্ন খেলাধুলা আমাদের দেহ গঠনে সাহায্য করে, তবে অনেক ক্ষেত্রে অসাবধানতার জন্য বা দুর্ঘটনার কারণে দাঁতে আঘাত লাগতে পারে ফলে দাঁত ভেঙে যেতে পারে অথবা সম্পূর্ণ উপড়ে যেতে পারে। এসব ক্ষেত্রে মডিথ গার্ড ব্যবহার করতে পারলে যে কোনো দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব।
৭. ধূমপান ও তামাক জর্দা ব্যবহার : ধূমপান ও তামাক জর্দা যে শুধু দাঁতের স্বাভাবিক সুন্দর রঙকে বিবর্ণ বা কালো করে তাই নয়, এই ধূমপান তামাক ব্যবহার মানুষের ক্যানসারও হতে পারে। অতএব
সুস্থ দাঁত ও মুখের নিশ্চয়তার জন্য তামাক বর্জন করা জরুরি। এ ব্যপারে একজন ক্লিনিক্যাল সাইক্লোজিস্ট বা কাউন্সিলারের
সাহায্য নেওয়া প্রয়োজন।
৮. দাঁত ও মাড়ির সুস্থতার জন্য পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহণ : যে কোনো বয়সে সুসম খাদ্য গ্রহণ অপরিহার্য। বিজ্ঞানীরা মনে করেন—কোনো কোনো খাদ্যের মধ্যে ওমেগা ও ফ্যাট আছে যা দাঁত ও মাড়ির প্রদাহ প্রতিরোধ করে। তবে প্রতিদিন কিছু শাক-সবজি যেমন : লালশাক, পালংশাক, পুঁইশাক, গাজর, টম্যাটো, শসা, লেবু এবং ফলের মধ্যে কমলালেবু, জাম্বুরা, কামরাঙ্গা, আমড়া, পেয়ারা, কলা ইত্যাদি জাতীয় খাবার দাঁত ও মাড়িকে শক্ত রাখে।
৯. শরকরা ও মিষ্টিজাতীয় খাবার পরিহার করা : মুখের বিভিন্ন ধরনের ব্যাক্টেরিয়া মিষ্টি বা শরকরাজাতীয় খাবারের সাথে মিশে গিয়ে অ্যাসিড তৈরি করে, ফলে দাঁতের এনামেল তাড়াতাড়ি ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। সুতারাং মিষ্টিজাতীয় খাদ্য গ্রহণের পর দাঁত ব্রাশ করা বা কুলিকুচি করা জরুরি। বিশেষ করে শিশুরা রাতে শোবার আগে ফিডারে যদি দুধ খায় এবং তাতে চিনিমিশ্রিত থাকে অথবা চকলেট খায় তবে দাঁত অবশ্যই ব্রাশ করে নেয়া প্রয়োজন।
১০. ডেন্টিসের সঙ্গে সাক্ষাৎ : গবেষকরা মনে করেন—প্রতি ছয় মাস অন্তর ডেন্টাল চেক আপ করানো গেলে দাঁতের রুটিন ডেন্টাল স্কেলিংয়ের মাধ্যমে প্লাক পরিষ্কার করা হলে দাঁতের ক্যারিজ ও মাড়ির রোগ অনেক প্রতিরোধ করা সম্ভব; যা কিনা ব্রাশ বা ডেন্টাল ফ্লসের মাধ্যমে সম্ভব নয়। তাছাড়া নিয়মিত ছয় মাস অন্তর ডেন্টাল চেক আপের ফলে আরো যেসব উপকার হয় তা হলো—
lমুখের ভেতরে ক্যানসারের পূর্বাবস্থায় কোনো লক্ষণ দেখা দিলে তা নির্ণয় করে দ্রুত রোধ করা সম্ভব। প্রতি ১০টি মুখের ক্যানসারের মধ্যে ৯টিকে আগে থেকে চিহ্নিত করতে পারলে সুস্থ করা সম্ভব।
দাঁতের বিভিন্ন ক্ষয় যথা (এনামেল ক্ষয়) মাড়ির ক্ষয় রোধ করা সম্ভব।
* মাড়ি রোগের প্রাথমিক লক্ষণ মাড়ি থেকে রক্ত পড়া শনাক্ত করতে পারলে অতি সহজেই চিকিত্সা করে সুস্থ করা সম্ভব।
lদেহের অনান্য রোগ যেমন—ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, কিডনি রোগ, হূদরোগ তাদের ওষুধ গ্রহণের কারণে মুখে প্রভাব পড়তে পারে। যেমন শুষ্ক মুখ সেটাও আগে থেকে নির্ণয় করা গেলে উপযুক্ত ব্যবস্থা দেওয়া সম্ভব।