উইন্ডোজ পিসি নাকি অ্যাপলের ম্যাক – কোনটি কিনবেন?

কর্তৃক প্রযুক্তি সারাদিন
0 মন্তব্য 617 ভিউজ

বহুদিন ধরেই প্রযুক্তি বিশ্বে একটি দ্বিধাবিভক্ত আলোচনার বিষয় “উইন্ডোজ নাকি ম্যাক”। এ নিয়ে বিতর্কেরও শেষ নেই। দুটি প্ল্যাটফর্মেরই ব্যবহারকারীভেদে সুবিধা-অসুবিধা রয়েছে। উইন্ডোজ পিসি তুলনামূলক কম দামে কেনা যায়। অপরদিকে সুদৃশ্য আইম্যাক, ম্যাকবুক এবং এদের রেটিনা মনিটর প্রথম দেখায় ভালো লেগে যাওয়ার মত, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু তার পরেও দাম ও কাস্টমাইজেশনের দিক থেকে বিবেচনা করলে ম্যাক সবার জন্য না। চলুন দেখে নিই উইন্ডোজ পিসি অথবা ম্যাক কেনার জন্য কোন কারণগুলো বিবেচ্য হতে পারে।

দাম

সবচেয়ে কম দামী অ্যাপলের কম্পিউটার ম্যাক মিনি কিনতে হলেও আপনাকে কমপক্ষে ৫০০ ডলার (বাংলাদেশে অন্তত ৫০ হাজার টাকা) গুণতে হবে। তাও শুধু সিপিইউ পাবেন। মাউস, কিবোর্ড, মনিটর আলাদা কিনতে হবে। অপরদিকে এর চেয়ে কম দামে আপনি এরকম কিংবা আরও ভালো কনফিগারেশনের একটি উইন্ডোজ পিসি কাস্টম বিল্ড করে নিয়ে দিব্যি চালিয়ে নিতে পারবেন। এমনকি এই দামে মধ্যম কনফিগারেশনের কিছু নোটবুক পিসিও পেয়ে যাবেন। আর অ্যাপলের সবচেয়ে কমদামের ল্যাপটপ ম্যাকবুক এয়ারও আপনার পকেট থেকে ১০০০ ডলার খসিয়ে নিবে।

বৈচিত্র্য

অফিসিয়ালি ম্যাকওএস চালিত কম্পিউটার একমাত্র অ্যাপলই তৈরী করে এবং তারা বছরে সাধারণত দুই-তিনটির বেশি মডেল বাজারে ছাড়ে না। আরেকটা ব্যাপার হলো, অ্যাপলের সব কম্পিউটারের ডিজাইন সেইম সিরিজের মধ্যে প্রায় একই রকম। তবে প্রতি বছর অ্যাপল এগুলোর পার্ফরমেন্স আপগ্রেড করে। তাই আপনার চয়েজ অপশন খুবই সীমিত হয়ে যাচ্ছে। বাজেট যত বেশিই থাকুক না কেন, ম্যাক কিনতে হলে আপনি অ্যাপলের সীমিত কিছু মডেলের বাইরে যেতে পারবেন না। অপরদিকে উইন্ডোজ পিসিগুলো এদিক দিয়ে আপনাকে পূর্ণ স্বাধীনতা দেবে। বিশ্বের বিভিন্ন কোম্পানি মাইক্রোসফটের সাথে চুক্তি করে উইন্ডোজ পিসি তৈরি করছে। এমনকি আপনার পিসিতে ম্যানুফ্যাকচারার উইন্ডোজ ইনস্টল করে না দিলেও আপনি পছন্দমত পিসি কিনে উইন্ডোজ ইনস্টল করে নিতে পারবেন। প্রতি বছর উইন্ডোজ পিসির অসংখ্য মডেল বের হচ্ছে।

কাস্টমাইজেশন

ম্যাকবুক ল্যাপটপ কিংবা ম্যাক ডেস্কটপগুলো কাস্টমাইজেশনের দিক থেকে খুবই সীমিত। আপনি র‍্যাম ও স্টোরেজের বাইরে তেমন কোনো কাস্টমাইজেশন করতে পারবেন না। অপরদিকে উইন্ডোজ পিসিগুলো হাইলি কাস্টমাইজেবল। ইন্টেল, এএমডি এর প্রসেসর এমনকি এআরএম প্লাটফর্মের কোয়াল্কম চিপসেটেও উইন্ডোজ ওএস চলে। যার ফলে আপনি যেভাবে খুশি আপনার পিসি কাস্টমাইজ করে বানিয়ে নিতে পারবেন।

ইকোসিস্টেম

প্রযুক্তি নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে থাকলে আপনি নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন যে, অনেকেই “অ্যাপল ইকোসিস্টেম” শব্দটি ব্যবহার করেন। মূলত এটা দ্বারা বুঝানো হয় যে অ্যাপলের তৈরী বিভিন্ন ডিভাইস যেমন আইফোন, আইপড, ওয়াচ, ম্যাক, টিভি সবকিছু কয়েকটি কমন ক্রস-ডিভাইস  ফিচার প্রোভাইড করে, যার ফলে আপনার ইউজার এক্সপেরিয়েন্স আরো সহজ ও সুন্দর হয়। তাই ম্যাক ব্যবহার করলে আপনি অ্যাপলের অন্যান্য ডিভাইসের সর্বোচ্চ সুবিধা নিতে পারবেন যা উইন্ডোজে সম্ভব না। মাইক্রোসফটেরও ইকোসিস্টেম আছে। কিন্তু অ্যাপলের ইকোসিস্টেম তার চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী।

প্রফেশনাল লেভেল বিল্ট-ইন সফটওয়্যার

ম্যাকওএস এর জন্য অ্যাপল আইমুভি, গ্যারাজ ব্যান্ড, ইমেজ ক্যাপচার এর মতো প্রফেশনাল লেভেলের কিছু সফটওয়্যার ফ্রি দিয়ে থাকে। তাই ভিডিও এডিট কিংবা মিউজিক কম্পোজের জন্য আপনি আলাদা প্রফেশনাল সফটওয়্যার না কিনেও কাজ চালাতে পারবেন। উইন্ডোজে এ ধরনের কিছু ফ্রি সফটওয়্যার বিল্ট-ইন/ডাউনলোডেবল থাকলেও সেগুলোর ফাংশনালিটি তুলনামূলক বেসিক বলা যায়।

ব্লোটওয়্যার

উইন্ডোজ পিসি বিভিন্ন ম্যানুফ্যাকচারারের কাছ থেকে আসায় পিসিতে ঐসব কোম্পানি কর্তৃক দেয়া বিভিন্ন সফটওয়্যার ইনস্টল করা থাকে। এভাবে আসা অতিরিক্ত সফটওয়্যারগুলোকে ব্লোটওয়্যার বলে। এদের অধিকাংশই ব্যবহারকারীদের খুব একটা কাজে লাগেনা। তাছাড়া আপনি ফ্রেশ উইন্ডোজ ইনস্টল করলেও মাইক্রোসফট অটোমেটিক কিছু প্রমোশনাল গেইমস ও অ্যাপস দিয়ে দেয়। এগুলো আনইনস্টল করা গেলেও খুবই বিরিক্তিকর। অন্যদিকে ম্যাকে এই সমস্যা নেই।

ওএস আপগ্রেড ফি

আপনি ম্যাক কিনলে সেটাতে ম্যাকওএস ইন্সটল করাই থাকবে এবং ভবিষ্যতে যা আপডেট আসবে সেগুলো ফ্রি’তেই ইন্সটল করতে পারবেন। অন্যদিকে আপনার ম্যানুফ্যাকচারার আপনাকে উইন্ডোজ ইন্সটল্ড পিসি বিক্রি না করে থাকলে আপনাকে টাকা খরচ করে আবার উইন্ডোজ ওএস কিনতে হবে। তাছাড়া উইন্ডোজ এর পুরাতন ৭, ৮, কিংবা ৮.১ ব্যবহার করলে এবং কোনো অফার না থাকলে টাকা খরচ করে উইন্ডোজ ১০ এ আপগ্রেড করতে হবে।

গেমিং

অন্তত এক্ষেত্রে কোনো বিতর্কের অবকাশ নেই যে গেমিং এর ক্ষেত্রে উইন্ডোজই সেরা। শক্তিশালী সব উইন্ডোজ মেশিন কাস্টম বিল্ড করে আপনি গেমিং এর চূড়ান্ত মজা নিতে পারবেন। ম্যাক হার্ডওয়্যারের দিক থেকে দিনে দিনে শক্তিশালী হলেও আপনি ভালো গেমগুলো খেলতে পারবেন না। কারণ বেশিরভাগ ভিডিওগেমসই উইন্ডোজ প্লাটফর্মের জন্য ডেভেলপ করা হয়। অ্যাপলের ম্যাকগুলো গেমিংয়ের জন্য অপটিমাইজড না।

কানেকশন পোর্ট

ম্যাক পিসি, বিশেষ করে ম্যাকবুকগুলোকে কম্প্যাক্ট ডিজাইনের করতে গিয়ে অ্যাপল অনেক পোর্টই বাদ দিয়ে দেয়। যার ফলে আপনি আপনার ম্যাকের সাথে সরাসরি রেগুলার এইচডিএমআই, ভিজিএ কিংবা এসডি কার্ড সংযুক্ত করতে পারবেন না। এজন্য আপনাকে বিভিন্ন এডাপ্টার ব্যবহার করতে হবে। অপরদিকে উইন্ডোজ পিসিতে অনেক ধরনের পোর্ট বিল্ট ইন থাকছে। যদিও, এটা উইন্ডোজের নিজের কোনো ক্রেডিট না!

নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার

ম্যাক পিসিগুলোতে অ্যাপল বছরের নির্দিষ্ট সময়ে নতুন স্পেসিফিকেশন আপগ্রেড নিয়ে আসে। তাই নতুন কোন হার্ডওয়্যার টেকনোলজি এলে আপনাকে অ্যাপলের নতুন পিসি ঘোষণা দেয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু উইন্ডোজ পিসির অনেক প্রস্তুতকারক থাকায় বাজারে প্রতিযোগিতা বেশি। যার ফলে আপনি পছন্দের টেকনোলজি আপগ্রেড কোন না কোন ম্যানুফ্যাকচারার এর কাছ থেকে চাইলে দ্রুতই পেতে পারেন।

সফটওয়্যার সাপোর্ট

ম্যাকে এমন কিছু সফটওয়্যার আছে যা শুধু ম্যাকের জন্যই এইভেইলেবল। তবে এ সংখ্যাটা খুব বেশি না। প্রায় সব অ্যাপই উইন্ডোজ প্লাটফর্মে এভেইলেবল। কিন্তু গেম সহ কিছু অ্যাপ আছে যেগুলো শুধুমাত্র উইন্ডোজ প্ল্যাটফর্মেই এভেইলেবল। উইন্ডোজে আপনি চাইলে স্টোরের বাইরে বা স্টোর থেকে সফটওয়্যার ইনস্টল করতে পারেন। বড় বড় সফটওয়্যার সাধারণত স্ট্যান্ডঅ্যালোন অফলাইন ইনস্টলার নিয়েই আসে। তবে ম্যাকে কিছু সফটওয়্যার আছে যেগুলো শুধুমাত্র অ্যাপ স্টোর থেকেই ইনস্টল করা যায়। বাইরে সেগুলোর ইনস্টলার পাওয়া যায়না। যেমন স্ক্রিনশট/স্ক্রিন রেকর্ডার টুল মনোস্ন্যাপ

ওএস ফ্লেক্সিবিলিটি

ম্যাক খুব ভালো ওএস হলেও সহজে ব্যবহারযোগ্য করতে গিয়ে কাস্টমাইজেশন অপশন খুবই সীমিত রাখা হয়েছে। তবে সিমপ্লিসিটির দিক দিয়ে ম্যাক অপারেটিং সিস্টেমকে অনেকেই এগিয়ে রাখেন। কারণ তারা সিম্পল ও ক্লিন ওএস বেশি পছন্দ করেন। কিন্তু উইন্ডোজ ওএস তুলনামূলক বেশি কাস্টমাইজেবল হওয়াতে পাওয়ার ইউজাররা এই সুবিধাটা নিতে পারেন।

মেরামত খরচ

উইন্ডোজ পিসির সার্ভিস সেন্টার সহজেই খুঁজে পাওয়া যায় এবং নষ্ট হলে ঠিক করাটাও তুলনামূলক কম খরচের। অপরদিকে ম্যাক এর কম্পোনেন্ট ও সার্ভিস সেন্টার উভয়ই সেই তুলনায় খুঁজে পাওয়া কঠিন। পেলেও খরচ অনেক বেশি।

নিরাপত্তা

অনেকেরই ধারণা উইন্ডোজের চেয়ে ম্যাক বেশি নিরাপদ। আসলে ব্যবহারকারী কম হওয়ার কারণে ম্যাকওএসের জন্য কম ম্যালওয়্যার তৈরি করা হয়। যেহতু উইন্ডোজ ব্যবহারকারী বেশি, তাই উইন্ডোজকেই বেশি টার্গেট করে ম্যালওয়্যার তৈরি করা হয়। নিরাপত্তার ক্ষেত্রে উভয় ওএসেই বিভিন্ন ফিচার আছে। এদের উভয়ের জন্যই এন্টিভাইরাস সফটওয়্যার আছে। নিরাপত্তার ব্যাপারটি ব্যবহারকারীর সচেতনতার ওপরেও নির্ভর করে। থার্ড-পার্টি সফটওয়্যার ব্যবহারের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন না করলে যেকোনো অপারেটিং সিস্টেমে আপনি সাইবার হামলার শিকার হতে পারেন।

সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে সুবিধা কোনটিতেঃ 

অ্যাপল প্রতিবছর সীমিত কিছু মডেলের ম্যাক রিলিজ করলেও এটার সবচেয়ে ভালো দিক হচ্ছে আপনাকে সিদ্ধান্ত নিতে চিন্তা করতে হয় না। অ্যাপলের পণ্যের কোয়ালিটিও ভাল। তাই আপনার বাজেট ও চাহিদা অনুযায়ী অ্যাপলের ডেস্কটপ বা ল্যাপটপ কিনে নিলেই হয়ে গেলো। অপরদিকে উইন্ডোজ পিসি অসংখ্য কোম্পানি তৈরী করে। তাই এত এত মডেল থেকে “ভ্যালু ফর মানি” মডেলটি খুঁজে পাওয়া বেশ কষ্টসাধ্য। আবার সব ধরনের কোম্পানির গুণগত মানও এক না। এক্ষেত্রে আপনাকে থার্ড-পার্টি রিভিউ এবং ভাগ্যের উপরও কিছুটা নির্ভর করতে হবে। অবশ্য, আজকাল ম্যাকও অহরহ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তাই উভয় ক্ষেত্রেই ‘ভাগ্য’ একটা বড় ব্যাপার।

0 মন্তব্য
0

তুমিও পছন্দ করতে পার

মতামত দিন