চিকুনগুনিয়া জ্বর ও তার প্রতিকার

কর্তৃক মাহমুদুল হাসান
0 মন্তব্য 1139 ভিউজ

চিকুনগুনিয়া কি:

চিকুনগুনিয়া (Chikungunya) ভাইরাসজনিত মশাবাহিত একটি রোগ। মশার মাধ্যমে এই ভাইরাস মানুষের মধ্যে ছড়ায়। ১৯৫২ সালে সর্বপ্রথম তানজানিয়ার দক্ষিণাঞ্চলে এই রোগ ছড়ানোর কথা জানা যায়। চিকুনগুনিয়া নামটি সেখানকার স্থানীয় কিমাকোন্ডি ভাষা থেকে এসেছে। যার অর্থ দাঁড়ায় ‘মোচড়ানো’। এই ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা হওয়ায় এই রোগের এমন নামকরন করা হয়েছে। চিকুনগুনিয়া বাহিত মশাগুলোর শরীরের ও পায়ের সাদা কালো ডোরাকাটা দাগ আছে যা দেখে সহজেই চেনা যায়। মানুষ ছাড়াও বানর, পাখি এবং ইঁদুর ও এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়।

চিকুনগুনিয়া ভাইরাস শরীরে প্রবেশের পরবর্তী দুই থেকে চার দিনের মধ্যে আকস্মিক জ্বর, পাশাপাশি সর্দি, হাত ও পায়ের গিঁটে ব্যথা শুরু হয়, যা কয়েক সপ্তাহ, মাস এমনকি বছর পর্যন্ত থাকতে পারে। জ্বরের মাত্রা কখনও কখনও ১০৪ থেকে ১০৫ ডিগ্রি কিংবা তারও বেশি হতে পারে। এই রোগের মৃত্যু ঝুঁকি প্রতি দশ হাজারে এক জন বা এর চেয়েও কম অর্থাৎ মৃত্যুঝুঁকি নেই বললেই চলে। তবে বয়স্ক মানুষের ক্ষেত্রে এই রোগের জটিলতা তুলনামূলক একটু বেশি হতে পারে। এই রোগে আক্রান্ত কাউকে মশা কামড়ানোর পর ওই মশা অন্য কাউকে কামড়ালে ওই ব্যক্তিও চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হবেন।

চিকুনগুনিয়া রোগের লক্ষণ ও উপসর্গসঃ

(১) হঠাৎ জ্বর আসা এবং পায়ের গিঁটে গিঁটে প্রচণ্ড ব্যথা।

(২) প্রচণ্ড মাথাব্যথা

(৩) শরীরে ঠাণ্ডা অনুভূতি

(৪)গায়ে লাল লাল দানার মতো র‍্যাশ দেখা যেতে পারে।

(৫) চামড়ায় লালচে দানা দেখা দেয়া

(৬) মাংসপেশিতে ব্যথা

(৭) শিশুদের ক্ষেত্রে স্নায়বিক জটিলতা (যেমন খিঁচুনি বা এনকেফালাইটিস)

(৮)শরীর অনেক দুর্বল হয়ে যাওয়ার কারনে বার বার বমি বমি ভাব বা বমি হতে পারে।

(৯) অনেক ক্ষেত্রে চোখ লাল হয়ে যাওয়া বা চোখের মধ্যে ব্যথা অনুভূত হতে পারে।

অধিকাংশ চিকুনগুনিয়া রোগীই পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠেন। তবে অস্থি সন্ধির ব্যথা কয়েক মাস এমনকি কয়েক বছর পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে চোখ, হৃদপিণ্ড, স্নায়ুতন্ত্রের সমস্যাও দেখা দেয়।

চিকুনগুনিয়া

চিকুনগুনিয়া রোগ নির্ণয়ে পরীক্ষা:

চিকুনগুনিয়া রোগের সন্দেহ হলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে তা নিশ্চিত হওয়া যায়। RT-PCR কিংবা সেরোলজির মাধ্যমে এ রোগ শনাক্ত করা যেতে পারে। এতে ২ হতে ১২ দিন লাগতে পারে।

বাংলাদেশ সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিটিউট (আইইডিসিআর)-এ চিকুনগুনিয়া রোগ নির্ণয়ের সকল পরীক্ষা করা হয়।

চিকুনগুনিয়া রোগের চিকিৎসা:

চিকুনগুনিয়ার কোন সুনির্দিষ্ট অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ নেই। সাধারণত উপসর্গ দেখে ব্যথা কমানোর জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ অনুসারে চিকিৎসা দেওয়া হয়। আক্রান্ত ব্যক্তিকে বিশ্রাম নিতে হবে, প্রচুর পানি পান করার পাশাপাশি ডাবের পানি, স্যালাইন, লেবুর সরবত ইত্যাদি তরলজাতীয় খাবার খেতে হবে এবং প্রয়োজনে জ্বর ও ব্যথার জন্য প্যারাসিটামল ট্যাবলেট এবং চিকিৎসকের পরামর্শ অনুসারে ওষুধ খেতে হবে।  মাঝে মাঝে পানি দিয়ে শরীর মুছে দেয়া যেতে পারে।

গিটের ব্যথার জন্য গিঁটের উপরে ঠাণ্ডা পানির স্যাঁক এবং হালকা ব্যায়াম উপকারী হতে পারে। তবে প্রাথমিক উপসর্গ ভালো হওয়ার পরও যদি গিঁটের ব্যথা ভালো না হয়, তাহলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। রোগীকে যেন মশা না কামড়ায় এ জন্য রোগীকে অবশ্যই মশারির ভেতরে রাখতে হবে। কারণ- আক্রান্ত রোগীকে কামড় দিয়ে, পরবর্তীতে কোনো সুস্থ ব্যক্তিকে সেই মশা কামড় দিলে ওই ব্যক্তিও এ রোগে আক্রান্ত হবেন।

চিকুনগুনিয়া রোগ প্রতিরোধ:

চিকুনগুনিয়া জ্বরের কোনো প্রতিষেধক বা টিকাও নেই। তাই রোগ থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় হলো মশা প্রতিরোধ। মশার উৎপত্তি স্থল ধ্বংস করা এবং মশা নির্মূল করাই মূল লক্ষ্য। বাসাবাড়ির আশপাশে যেখানে পানি জমে থাকতে পারে, তা সরিয়ে ফেলতে হবে এবং নিয়মিত পরিষ্কার রাখতে হবে। এছাড়া ডাবের খোসা, কোমল পানীয়ের ক্যান, ফুলের টব এসব স্থানেও যাতে পানি জমে না থাকে, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে।

‘মশার কামড় থেকে সুরক্ষাই চিকুনগুনিয়া থেকে বাঁচার সবচেয়ে ভালো উপায়। রাতের বেলায় মশারি টানিয়ে ঘুমানো, জানালায় নেট ব্যবহার করা, প্রয়োজন ছাড়া দরজা-জানালা খোলা না রাখা, শরীরে মশা প্রতিরোধক ক্রিম ব্যবহার করার মাধ্যমেই এই রোগ প্রতিরোধ সম্ভব।’ এডিস মশা সাধারণত দিনের বেলা কামড়ায়। তাই শিশু, অসুস্থ বা বৃদ্ধ যারা দিনের বেলা ঘুমান তাদের মশারি ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হয়।

চিকুনগুনিয়া রোগ সর্ম্পকে পরামর্শ:

ডেঙ্গুজ্বরে সাধারনত তিন থেকে চারবার পর্যন্ত হতে পারে। অপরদিকে চিকুনগুনিয়া একবার হলে সাধারণত আর হয় না। এছাড়া অনেক বিষয়েই ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া রোগের মধ্যে সাদৃশ্য আছে। একটানা তিন দিন জ্বর ও হাড়ের জোড়ে প্রচণ্ড ব্যথা থাকলে অতি দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে এবং পরামর্শ অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে।

চিকুনগুনিয়া আক্রান্ত মায়ের দুধ সন্তান পান করলে সাধারণত চিকুনগুনিয়া হয় না,তাই আক্রান্ত মায়েদের চিন্তিত হওয়ার তেমন কোনো কারণ নেই।

এছাড়া রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) স্বাস্থ্য অধিদপ্তর স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়, তাদের ওয়েবসাইটে চিকুগুনিয়া নিয়ে বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করেছে।

0 মন্তব্য
0

তুমিও পছন্দ করতে পার

মতামত দিন